সদরঘাট লঞ্চগুলোর বিভিন্ন নিরাপত্তা ত্রুটির অভিযোগ, সমুদ্রযাত্রা কতটা নিরাপদ?
সম্প্রতি মধ্যরাতে একটি নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৪৩ যাত্রী নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।
শাদুক লঞ্চগুলো যেগুলো সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়, সেগুলোর অনেকেরই নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে। লঞ্চ মালিকরা অবশ্য নিরাপত্তার ত্রুটি সত্ত্বেও এসব লঞ্চ চলাচলের জন্য কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন।
দেশের লঞ্চ, অনুমোদন বা সমুদ্রযাত্রার নিরাপত্তা- সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রকৃতপক্ষে জাহাজ চলাচল কতটা নিরাপদ তা নিয়ে বিস্তর উদ্বেগ রয়েছে।
সবচেয়ে বড় নৌ দুর্ঘটনা:
২০০৩ সালের ৭ জুলাই ঢাকার কাছে চাঁদপুরের মুখে এমভি নাসরিন নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ প্রায় ৬০০ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায়।
ওই লঞ্চের যাত্রী ছিলেন রেজাউর রহমান শাহীন।
ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, "এমভি নাসরিন লঞ্চটি সন্ধ্যা ৭টায় সদরঘাট থেকে ভোলার লালমোহনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। লোকজন চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। একজন ট্রলার এসে আমাকে উদ্ধার করে। আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে যাই।"
যদিও মিঃ রহমান বেঁচে যান, দুর্ঘটনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে 110 জনের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং 199 জন নিখোঁজ হয়। যদিও বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা অনেক বেশি।
এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় লঞ্চটির নকশা তদারকি দলকে কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়। কিন্তু তাতে লঞ্চ দুর্ঘটনা মোটেও কমেনি।
এর সর্বশেষ উদাহরণ হল গত মাসে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি এক্সপিডিশন 10। আগুনে অন্তত ৪৩ জন যাত্রী নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় অনেক যাত্রী হারিয়েছেন তাদের প্রিয়জন। মমতাজ বেগম নামে এক যাত্রী মো.
"অগ্নিকাণ্ডের পর অনেক দৌড়াদৌড়ি হয়েছে। আমি নিচে গিয়ে আমার স্ত্রী ও নাতনিকে খুঁজে পাইনি। সেখানে আমি পুড়ে যাই। লঞ্চের মাথায় আগুন লেগে যায়। লঞ্চের ক্রুসহ কেউ ছিল না।" আমি এখনো বউ পাইনি।"
বাংলাদেশে লঞ্চ ডুবে যাওয়ার বা দুটি লঞ্চের মধ্যে সংঘর্ষের খবর মাঝেমধ্যে পাওয়া গেলেও, এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড যা মধ্যরাতে পুরো লঞ্চটিকে গ্রাস করেছে বাংলাদেশের নৌ চলাচলের ইতিহাসে বিরল।
ঘটনার পর মালিক-চালকসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও এদেশে সমুদ্রযাত্রা কতটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে শুধু ২০২১ সালেই ৫০০টির বেশি নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এর আগের বছর 2020 সালে দেশে 1,203টি নৌ দুর্ঘটনায় 953 জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। এর আগে, 2019 সালে, 620টি জাহাজ দুর্ঘটনায় 65 জন এবং 2016 সালে 506টি জাহাজ দুর্ঘটনায় 426 জনের মৃত্যু হয়েছিল।
একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে নদীতে ৩ হাজার ৪৬টি নৌকা দুর্ঘটনায় ৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
কিন্তু এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক রুটে একের পর এক বিলাসবহুল লঞ্চ চালু হয়েছে। লঞ্চগুলোতে আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে, গতি বাড়িয়েছে, যা ভ্রমণের সময় কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তার পরেও দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে।
সরকার যা বলছে
নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দোষারোপ না করে মালিকদের উচিত যাত্রীসেবার দিকে বেশি নজর দেওয়া এবং জাহাজগুলোকে প্রযুক্তিগতভাবে নিরাপদ করতে সংস্কার করা।
"অবশ্যই, যাদের এসব দেখতে হবে তাদের দুর্বলতা আছে। সার্ভেয়ারদের দুর্বলতা আছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের যা করণীয় আমরা তা করছি। কিন্তু আমরা যদি সঠিক সেবা প্রদান করি, তাহলে সার্ভেয়ারের প্রয়োজন নেই। সবাই দায়িত্বশীল হলে, অনেক কাজ কমে গেছে। নিরাপত্তার জন্য ডিজাইন পরিবর্তন করতে হবে। যাত্রীদেরও দায়িত্ববোধ আছে।"
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় কে কোন সময়ে যাত্রা করবে, নৌপরিবহন অধিদপ্তর এবং রুট পারমিট থেকে শুরু করে, জাহাজের নকশা তদারকি করে এবং সেই অনুযায়ী জাহাজের নির্মাণ।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বলছে, নৌপরিবহন খাত যতটা সম্প্রসারিত হয়েছে, ততটা বাড়েনি এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা।
আবার এক শ্রেণীর মালিকের সীমাহীন ক্ষমতাও এ খাতের নানা অনিয়মের উৎস। এসব কারণে বাংলাদেশের নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
0 মন্তব্যসমূহ